অর্পিত সম্পত্তি আইনের প্রধান উপাদানসমূহ লিখ
ভূমিকা: ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের অনেক নাগরিক তাদের নিজস্ব সম্পত্তি ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এই সম্পত্তিগুলোকে 'শত্রু সম্পত্তি' নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৪ সালে এই আইনটির নাম পরিবর্তন করে 'অর্পিত সম্পত্তি আইন' করা হয়। ২০১১ সালে এই আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়। অর্পিত সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তির অধিকার সুনির্দিষ্ট করা হয় এবং যারা এসব সম্পত্তির মালিক তারা কীভাবে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়। এই আইনটি সুষ্ঠু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।
অর্পিত সম্পত্তি আইনের প্রধান উপাদানসমূহ:
এ আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সম্পত্তির তালিকা ও আবেদন প্রক্রিয়া: অর্পিত সম্পত্তি আইনের প্রথম উপাদান হলো 'ক' এবং 'খ' তফসিলের মাধ্যমে সম্পত্তির তালিকা প্রকাশ। 'ক' তফসিলে সরকারের দখলে থাকা সম্পত্তির তালিকা রয়েছে এবং 'খ' তফসিলে সরকারের দখলে না থাকা কিন্তু ব্যক্তির দখলে থাকা সম্পত্তির তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবেদন করা যাবে। 'ক' তালিকার সম্পত্তি ফেরত পেতে হলে জেলা জজের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে। অন্যদিকে, 'খ' তালিকার ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে ৩০০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। সম্পত্তির মালিক এবং তালিকা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াটি আরও সুস্পষ্ট করেছে।
২. সহ-অংশীদারদের অধিকার: এই আইনে সহ-অংশীদারদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো সম্পত্তি জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয়, যেমন দেবোত্তর সম্পত্তি, শ্মশান, বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, তাহলে এসব সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় নাগরিকরা গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে পারবেন। যদি কোনো নাগরিক আবেদন না করেন, তবে প্রশাসক একটি কমিটি গঠন করে সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করবে। এভাবে সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
৩. আইন সংশোধন ও নতুন উপাদান: অর্পিত সম্পত্তি আইনটি আগে অনেক ভুলত্রুটি ধারণ করেছিল, কিন্তু নতুন আইনটি সেই ভুলগুলো সংশোধন করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। এ আইনে সরকারের এবং আইন বিভাগের আন্তরিকতা স্পষ্ট, কারণ এটি সম্পত্তির মালিকানা বিতর্কের সমাধান করতে সাহায্য করছে। সুশীল সমাজও এই আইনটির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভুক্তভোগীদের জন্য এখনই সময় তাদের অধিকার দাবি করার।
৪. অংশীদারদের দাবি: এ আইনে অংশীদারদের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পূর্বের আইনটি অনুসরণ করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছ থেকে সম্পত্তি ইজারা বা লিজ নেন, তবে সেই ইজারা বা লিজ দেয়ার অধিকার অগ্রাধিকার পাবে, কিন্তু এটি এ আইনে সন্নিবেশিত করা হয়নি। এর ফলে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
৫. ইজারা দেওয়া সম্পত্তির ক্ষেত্রে নিয়ম: যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে অর্পিত সম্পত্তির ইজারা গ্রহণ করে, তবে সেগুলো ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, যদি ইজারা না দেওয়া হয়, তবে সেই সম্পত্তি অবশ্যই সহ-অংশীদারদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এভাবে সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার এবং মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
উপসংহার: অর্পিত সম্পত্তি আইনটি বাংলাদেশের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন। এটি শত্রু সম্পত্তি সম্পর্কিত নানা জটিলতা দূর করে এবং সঠিক মালিকদের হাতে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে। যদিও এই আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা এবং জটিলতা রয়েছে, তবে এর মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইনটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব রয়েছে, যাতে সঠিকভাবে জনগণের অধিকার রক্ষিত হয় এবং কোনোভাবে কেউ এর সুফল থেকে বঞ্চিত না হয়।
এ আইনটি ভবিষ্যতে আরও সুষ্ঠু ও কার্যকরীভাবে পরিচালিত হলে দেশের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় সুদৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেইসাথে ভুক্তভোগীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে।

No comments:
Post a Comment